বাংলাদেশে স্টারলিংক: ২০২৫ সালে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট বিপ্লবের পথে

ইলোন মাস্কের প্রতিষ্ঠিত স্পেসএক্সের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক ২০২৫ সালে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে। স্টারলিংকের এই উদ্যোগ বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাতে একটি নতুন যুগের সূচনা করবে, যা দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারের ধারণা পাল্টে দিতে পারে।

স্টারলিংক কী এবং এটি কিভাবে কাজ করে?

স্টারলিংক হলো একটি স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট পরিষেবা, যা পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে (Low Earth Orbit – LEO) স্থাপন করা হাজার হাজার ছোট স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সরবরাহ করে। এই প্রযুক্তি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা প্রদান করতে সক্ষম। ফলে, স্টারলিংক বিদ্যমান তারবিহীন (wireless) বা তারযুক্ত (wired) ইন্টারনেট পরিষেবার তুলনায় অনেক বেশি কভারেজ এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।

বাংলাদেশে স্টারলিংকের সম্ভাবনা

বাংলাদেশে স্টারলিংক চালু হওয়া মানে শুধু উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা পাওয়া নয়, বরং দেশের অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষ করে গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগের অভাব রয়েছে। এসব অঞ্চলে স্টারলিংক দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট সরবরাহে সক্ষম হবে।

স্টারলিংকের আগমন দেশের ডিজিটাল খাতে একটি বড় প্রভাব ফেলতে পারে। উচ্চগতির ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ব্যবসা-বাণিজ্য, এবং সরকারি সেবায় নতুন গতি আসবে। এর ফলে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ত্বরান্বিত হতে পারে।

বাংলাদেশে ইন্টারনেট বন্ধের চিত্র: গত ১০ বছরের পর্যালোচনা

বাংলাদেশে গত ১০ বছরে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধের ঘটনা বেশ কয়েকবার ঘটেছে, যা নাগরিকদের মাঝে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক অস্থিরতা, জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন এবং ধর্মীয় উত্তেজনার সময় ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনা দেখা গেছে।

১. ২০১৫ সাল: রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে বেশ কয়েকবার মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করা হয়। এটি ছিল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা যা ইন্টারনেট ব্যবহারের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

২. ২০১৮ সাল: শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করা হয়েছিল। এই পদক্ষেপটি আন্দোলন দমনে সরকারের একটি কৌশল হিসেবে দেখা হয়েছিল।

৩. ২০১৯ সাল: ধর্মীয় উত্তেজনার সময় এবং জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে বেশ কয়েকবার ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনা ঘটে। এসব সময়ে মোবাইল ডেটা বন্ধ করা হয়েছিল যাতে অপপ্রচার ও ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়তে না পারে।

৪. ২০২১ সাল: কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে নিরাপত্তার জন্য এবং কিছু রাজনৈতিক কারণে ইন্টারনেট বন্ধ ছিল।

৫. ২০২২ সাল: কিছু রাজনৈতিক মিছিল ও সমাবেশকে কেন্দ্র করে ইন্টারনেট সেবা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়।

২০২৪ সালের ইন্টারনেট বন্ধের প্রেক্ষাপট

২০২৪ সালে বাংলাদেশে ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনা একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে জুলাই-আগস্ট মাসে, ছাত্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে ইন্টারনেট সেবা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়।

জুলাই-আগস্ট ২০২৪: এই সময়ে সরকার বিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে সরকার ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই আন্দোলনটি বিশেষত সরকারের স্বৈরাচারী নীতির বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়। আন্দোলনকারীরা শিক্ষার্থী হওয়ায় তাদের সংগঠিত হওয়া ঠেকাতে এবং প্রতিবাদ দমনে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। এই ঘটনাটি পরে নানা নথি এবং রিপোর্টে প্রমাণিত হয়, যা সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা সৃষ্টি করে। ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী এবং খুলনায়ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়, যা স্থানীয় ব্যবসা, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবায় বিরূপ প্রভাব ফেলে।

ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ রাখার কারণে ছাত্রদের আন্দোলন দমন করা সম্ভব হলেও, এটি জনগণের মধ্যে ক্ষোভ এবং উদ্বেগ সৃষ্টি করে। বিশেষত, ইন্টারনেট বন্ধের সময়সীমা এবং তার প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং আন্তর্জাতিক মহল থেকে সমালোচনা আসতে থাকে।

স্টারলিংকের প্রেক্ষাপটে ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনা

স্টারলিংকের মতো স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা এই ধরনের ইন্টারনেট বন্ধের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়ক হতে পারে। কারণ এটি স্থানীয় অবকাঠামোর উপর নির্ভরশীল নয়। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সরাসরি ইন্টারনেট সেবা প্রদান করায় সরকার বা স্থানীয় সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে ইন্টারনেট বন্ধ করা তুলনামূলক কঠিন হবে। ফলে স্টারলিংক দেশের নাগরিকদের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট সেবা সরবরাহ করতে সক্ষম হবে, বিশেষ করে জরুরি অবস্থায়।

স্টারলিংকের জন্য সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ

স্টারলিংক বাংলাদেশে প্রবেশের আগে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। প্রথমত, স্টারলিংকের সেবার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও মাসিক ফি অনেকের জন্য ব্যয়বহুল হতে পারে। দেশের অনেক অঞ্চলে এখনও ইন্টারনেট সেবা কম খরচে পাওয়া যায়, যা স্টারলিংকের জন্য প্রতিযোগিতামূলক চ্যালেঞ্জ হতে পারে। এছাড়া, দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়মাবলী এবং নীতিমালাও স্টারলিংকের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলতে পারে।

তবে, স্টারলিংকের প্রবেশ বাংলাদেশে ইন্টারনেট খাতের একটি নতুন যুগের সূচনা করতে পারে। এটি দেশের ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে সহায়ক হবে এবং একটি নতুন ধরনের ইন্টারনেট অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারে, যা দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *